বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপার সাপের আতঙ্ক: বাস্তবতা কতটা?
রাসেলস ভাইপার (Russell's Viper), যা "চন্দ্রবোড়া" নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের তথা দক্ষিণ এসিয়ার অন্যতম একটি বিষধর সাপ। ২০০২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত বলে মনে করা হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুনরায় দেখা দিয়েছে। এই সাপটির দ্রুত বিস্তার জনগণের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশে
রাসেলস ভাইপার(Daboia russelii) সাপ নিয়ে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে
পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমে এই বিষধর সাপের বিভিন্ন ভয়ঙ্কর ছবি ও
ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, রাসেলস ভাইপার দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে এবং
মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠেছে।
বাস্তবতা কি?
- বন্যপ্রাণী
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাসেলস ভাইপার আসলে বাংলাদেশের স্থানীয় প্রজাতি। এটি দীর্ঘদিন ধরে
দেশের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করছে।
- সত্যিকার অর্থে,
রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বরং, আগের তুলনায়
এদের দেখা পাওয়া বেশি হচ্ছে কারণ মানুষ এখন সচেতন এবং সাপ সম্পর্কে আরও
খোঁজখবর নেয়।
- রাসেলস ভাইপার সাধারণত
আক্রমণাত্মক নয়। যদি না তাদের বিরক্ত করা হয় বা হুমকি অনুভব করে, তাহলে
তারা কামড়ায় না।
- রাসেলস ভাইপারের
কামড়ানো মারাত্মক হতে পারে, তবে সঠিক চিকিৎসা পেলে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। বাংলাদেশের বেশিরভাগ
হাসপাতালেই রাসেলস ভাইপারের বিষের অ্যান্টিভেনম রয়েছে।
রাসেলস ভাইপার চেনা:
- বর্ণনা: বাদামী বা হলুদ রঙের,
গায়ে গাঢ় বাদামি ফোঁটার সারি থাকে।
- আকার: গড়ে ১.২ মিটার (৪ ফুট)
দৈর্ঘ্য, তবে ১.৮ মিটার (৬ ফুট) পর্যন্ত হতে পারে।
- বাসস্থান: ঝোপঝাড়, বন,
কৃষিজমি, নদীর তীরবর্তী এলাকা।
- অরিজিনঃ ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল, এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায়।
- রঙ:
- বাদামী, লালচে বাদামী, বা তামাটে
বাদামী রঙের
- পিঠে গাঢ় বাদামী রঙের ডোরাকাটা
নকশা
- মাথায় একটি ত্রিভুজ চিহ্ন
আচরণ:
- নিশাচর সাপ
- সাধারণত শান্ত এবং লজ্জ্বাশীল, তবে
বিরক্ত হলে আক্রমণাত্মক হতে পারে
- শিকারের জন্য অ্যাম্বুশ তৈরি করে
খাদ্য:
- ইঁদুর, ছোট স্তন্যপায়ী, পাখি, এবং উভয়চর
বিষের প্রভাব:
- রাসেলস ভাইপারের বিষ
হিমোটক্সিন (Hemotoxic বা রক্ত বিষ), যা রক্তক্ষরণ, টিস্যু ক্ষতি এবং অঙ্গ বিকলতার কারণ হতে পারে।
- কামড়ানোর লক্ষণগুলির
মধ্যে রয়েছে তীব্র ব্যথা, ফোলাভাব, রক্তপাত, বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা এবং ঘাম।
- প্রায় ক্ষেত্রে, মৃত্যুও হতে পারে।
ভুল তথ্য ও আতঙ্ক:
- সোশ্যাল মিডিয়ায়
রাসেলস ভাইপার সম্পর্কে অনেক ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। যেমন, অনেকে ভুলভাবে
দাবি করছেন যে এই সাপ নতুন করে বাংলাদেশে এসেছে, অথবা এদের বিষ অত্যন্ত
মারাত্মক।
- এই ভুল তথ্যগুলি মানুষের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। অনেকেই সাপ দেখলেই মেরে ফেলছে, তা যে সাপই হোক না কেনো যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।
প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ:
- ঘন ঝোপঝাড় এড়িয়ে
চলুন, বিশেষ করে রাতের বেলা।
- উঁচু জুতা এবং লম্বা
পোশাক পরুন।
- আলোর ব্যবহার করুন যখন
রাতের বেলা বাইরে যান।
- সাপ দেখা গেলে শান্ত
থাকুন এবং দ্রুত সরে যান।
- সাপকে কখনোই বিরক্ত বা
মারার চেষ্টা করবেন না।
- রাসেলস ভাইপার কামড়ানো হলে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা নিন।
কী করবেন?
- রাসেলস ভাইপার
সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানুন। বিশ্বস্ত উৎস, যেমন
বন বিভাগের ওয়েবসাইট বা নিবন্ধ থেকে তথ্য সংগ্রহ করুন।
- সাপ দেখলে ভয় পাবেন না
এবং তাকে বিরক্ত করবেন না। যদি কোন সাপ দেখেন,
সাবধানে দূরে সরে যান এবং বন বিভাগকে জানান।
- মনে রাখবেন, সকল সাপই
বিষধর নয়। অনেক সাপই আমাদের জন্য উপকারী, কারণ তারা ক্ষতিকর
পোকামাকড় খায়।
- পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করুন। বন উজাড় বন্ধ করুন এবং বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল রক্ষা করুন।
রাসেলস ভাইপার একটি বিষধর
সাপ হলেও, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো
সম্ভব। এই সাপ সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ আপনাকে এবং আপনার
পরিবারকে নিরাপদ রাখতে সাহায্য করবে।
সবশেষে:
- রাসেলস ভাইপারের কামড়ানোর
চিকিৎসার জন্য অবিলম্বে চিকিৎসা সহায়তা নিন, ভুল করেও কোনও ওঝা বা কবিরাজের
কাছে যাবেন না, এর একমাত্র চিকিৎসা হল অ্যান্টি-ভেনম ইনজেক্ট করানো।
- একজন ডাক্তার অ্যান্টি-ভেনম
ইনজেক্ট করবেন এবং উপসর্গগুলি চিকিৎসা করবেন।
রাসেলস ভাইপার সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- এটি ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বাধিক
বিষধর সাপের কামড়ের জন্য দায়ী
- প্রতি বছর প্রায় 25,000 মানুষ
রাসেলস ভাইপারের কামড়ে মারা যায়
- রাসেলস ভাইপারের বিষ থেকে তৈরি অ্যান্টি-ভেনম পাওয়া যায়
অতিরিক্ত তথ্য:
- বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী
বিভাগ: https://bforest.gov.bd/
- ভেনম রিসার্চ সেন্টার,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ: https://anatomy.bsmmu.ac.bd/faculty-member/10479
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন